একটি ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুর্নীতি, দখলদারি, চাঁদাবাজি মুক্ত সুশৃঙ্খল দেশ প্রত্যাশা করেছিল প্রায় সব শ্রেণির মানুষ। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীদের একের পর এক নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ভোলাতে পারেনি পতিত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীদের অন্যায়-দুর্নীতি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ। যদিও দলের নেতাকর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে ৫ আগস্টের পর থেকেই শক্ত অবস্থানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অভিযোগ উঠলেই নিয়েছেন সাংগঠনিক ব্যবস্থা। তবু থামাতে পারছেন না নেতাকর্মীদের। বিষয়টি নিয়ে গোটা দলের মধ্যেই এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীদের যত নেতিবাচক কর্মকাণ্ড
গত ৫ আগস্টের পর বিএনপি নেতাকর্মীদের একাংশ সারাদেশে ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি, দখলবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ঘটেছে প্রাণহানির ঘটনাও। এসব ঘটনায় ক্ষুণ্ন হচ্ছে দলের ভাবমূর্তি।
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির নেতা ড. খোন্দকার আকবর হোসেন বলেন, ‘অন্য জায়গার মতো আমাদের মানিকগঞ্জেও দখলবাজিসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদী নেতারা এসব অপকর্মে জড়াচ্ছেন। এখন যারা এগুলো করছে তারা পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারেরও সুবিধাভোগী ছিল।’
নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা বিষয়ে যা বলছেন নেতারা
গত বছরের ৭ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তার রেকর্ড করা ভিডিও বক্তব্যে বলেন, শান্তি, প্রগতি ও সাম্যের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে আসুন আমরা তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। ধ্বংস, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি করি।
এরপর গত সাত মাসে অসংখ্যবার তারেক রহমান নেতাকর্মীদের সতর্ক করে বক্তব্য দিয়েছেন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তাতে অবশ্য খুব বেশি কর্ণপাত করেননি দলটির নেতাকর্মীরা। অন্তত গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ এবং দলের পক্ষ থেকে সাংগঠনিক ব্যবস্থার রেকর্ড সেটাই প্রমাণ করে।
তারেক রহমান পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন বক্তব্যে বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। যারা দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণ হবেন, ব্যক্তির চেয়ে দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আমাকে বাধ্য হয়েই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘সংগঠন আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতেই মূলত আমাদের এ সফর এবং মতবিনিময় সভা। তবে সভাগুলো থেকে দল নেতাকর্মীদের পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে যে, কোনো ব্যক্তির ভুলের দায় দল নেবে না।’
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না বলেন, ‘গত ২২ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা যুবদলের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম পিন্টুর নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন যুবক দিন-দুপুরে গামছায় মুখ বেঁধে রামদা হাতে স্থানীয় বাজারে যান। পিন্টু মাইকে ঘোষণা দেন, তিনি যতদিন বেঁচে আছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন। সরকারি ইজারাদার যেই হোক, খাজনা তাকে দিতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী বাধা দিলে কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে। এ ঘোষণার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ঘটনার দিন তাকে বহিষ্কার করে যুবদল। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের অনুরোধ নিয়ে আমি নিজে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘এ সমস্ত ঘটনায় আমাদের অনেক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। কুমিল্লায় আমাদের একজন মারা গেছে। আমরা এ নিয়ে প্রতিবাদ বা মুক্তির দাবিও করছি না। আমরা চাই সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এর বাইরে আর কী করা যায় যদি পরামর্শ পাই আমরা গ্রহণ করবো।’
দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, চাঁদাবাজি-দখলবাজির অভিযোগ, সংঘর্ষে জড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে উচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব শ্রেণির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে কমবেশি সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। অনেকের শাস্তি নির্দিষ্ট সময় পর তুলেও নেওয়া হয়েছে।
বিএনপি স্থানীয় সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক নিলোফার চৌধুরী মনি সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে দাবি করেন- এ পর্যন্ত তার দল তিন হাজারের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
কেন বন্ধ হচ্ছে না নেতিবাচক কর্মকাণ্ড? যা বলছেন শীর্ষ নেতারা
গত ১২ মার্চ এক সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, আওয়ামী লীগের ধূর্ত কর্মীরাই এখন বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলে ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির ছত্রছায়ায় তারা টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তারা বেশ পরিবর্তন করে চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। এরা অপকর্ম করে বিএনপির কর্মীদের নামে অপবাদ ছড়াচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে বিতাড়িত করতে হবে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যেভাবে বিএনপিকে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা দিয়ে কোনো কোনো মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছে। বিএনপির বিরুদ্ধে তারা নানা গুজব প্রচার করছে। এসবের অনেক ঘটনাই বানোয়াট।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘এর মূল কারণ কিছু লোক বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছে। প্রথমদিকে আমাদের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে সেভাবে দলের গুরুত্বপূর্ণ কেউ নেই। যারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাচ্ছে তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমাদের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা সম্পৃক্ত হচ্ছে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আমি মনে করি না বিএনপি অপকর্ম বা কুকীর্তির সঙ্গে জড়িত। বিএনপি অপপ্রচারের শিকার হচ্ছে। কারণ ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও মিডিয়াসহ সর্বত্র এখনো স্বৈরাচারের দোসরা রয়েছে। তাদের বিচারের আওতায় এনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত না করা পর্যন্ত এই অপকর্ম চলবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, ‘দলের যে সমস্ত নেতাকর্মী অপকর্মে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম হচ্ছে এবং বিএনপির ওপর দায় চাপানো হচ্ছে।’
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (বিএলডিপি) চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড জিরোতে নামেনি, তবে অনেকাংশে বন্ধ হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন-রাজনৈতিক দলের নেতারা আর বেকার- এই তিন গ্রুপ মিলে যে সিস্টেম তৈরি হয়েছে এই সিস্টেমে আঘাত করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘মানুষের যেমন চরিত্র থাকে রাষ্ট্রের তেমন চরিত্র থাকে। রাষ্ট্রের চরিত্র পতিত সরকার গত ১৫ বছরের নষ্ট করেছে। আইনের শাসনের মাধ্যমে তাদের দোসরদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনটা প্রকৃত আদর্শভিত্তিক হয়নি। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ৪২০ জন নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন। তারা গত দেড় দশক নির্যাতিত হয়েছেন। বিএনপি দলের শুদ্ধি অভিযানের সুযোগ পায়নি।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যক্তির চেয়ে দল বড় এবং দলের চেয়ে দেশ বড় বলছেন। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেখানেই টাকা দেখছেন সেখানেই দেশের চেয়ে দলকে বড় এবং দলের চেয়ে ব্যক্তিকে বড় করে হাট-বাজার দখল, চাঁদাবাজি সিন্ডিকেটের আধিপত্য ধরে রাখতে যাবতীয় কর্মকাণ্ড করছে। এ কারণে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। স্থানীয় নেতাদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে বিএনপি তার জনপ্রিয়তা হারাবে।’