সময়টা কেমন অদ্ভুত! বাংলাদেশের রাজনীতিতে কত উত্থান-পতন এর ইতিহাস পড়লাম শুনলাম এবং কিছু স্বচক্ষেও দেখলাম, আমার এই অল্প জীবনে বা অল্প বয়সে কত পরিবর্তন দেখলাম, কিন্তু কিছু গল্প যেন বারবার ফিরে আসে। বেগম খালেদা জিয়ার গল্পটা তেমনই। যাকে এককালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা বলা হতো, যিনি আপসহীনতার প্রতীক হিসেবে কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, আজ তিনি অসুস্থতার শয্যায়। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, যে নেত্রীর হাত ধরে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরুত্থান হয়েছিল, আজ তাকেই দেখতে হচ্ছে এক ভিন্ন বাংলাদেশের ছবি। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে জেলও খাটতে হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম, তিনি বলছেন আমি কার কাছে বিচার দিব আল্লাহ ছাড়া। আল্লাহ হয়তো সেদিন সত্যিকার অর্থেই তার হৃদয়ের আকুতিকে নোট করে নিয়েছিলেন এবং তারই ফলশ্রুতিতে হয়তোবা আওয়ামীলীগ সরকারের এমন লজ্জাজনক পতন হলো।
সত্যিকার অর্থেই এটা বেগম জিয়াকে দেখলে বুঝা যায় যে আল্লাহ যাকে সম্মান দেবেন তাকে দুনিয়ার কোন শক্তি নাই অপমানিত করার।
গণতন্ত্রের পথে এক সাহসী অভিযাত্রা
বেগম জিয়া কেবল কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান নন, তিনি আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল সেই প্রতিকূল সময়ে, যখন সামরিক শাসন দেশের গণতন্ত্রকে গলা টিপে ধরেছিল। এ জাতি ভুলে যায়নি সেই দিনগুলোর কথা, যখন তিনি একটি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। তার সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল দেশের আপামর জনগণ। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পেয়েছিল একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন, তার আমলে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার যে উন্নতি হয়েছিল, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন, একজন নারীও সাহসের সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ পদে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে তিনি বারবার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। শত প্রতিকূলতা ও মিথ্যা মামলার বেড়াজালে আটকে থেকেও তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি, যা তাকে ভয় ও লোভের ঊর্ধ্বে রেখেছে।
এক মানবিক উদ্যোগ ও রাজনৈতিক সৌজন্যের বার্তা
প্রতি বছর ১৫ই আগস্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক কাদা ছোড়াছুড়ি হয়েছে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তার অসুস্থতার কারণে এই জন্মদিনকে ঘিরে একটি মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেক কেটে উৎসব করার পরিবর্তে তার সুস্থতার জন্য দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যা রাজনৈতিক সৌজন্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। রাজনীতিতে মতভেদ থাকবে, কিন্তু মানবিকতা যেন কখনোই হারিয়ে না যায়।
তার সুস্থ জীবনের জন্য দোয়া করা, মিলাদ মাহফিল করা—এতে কোনো রাজনৈতিক বিভেদ থাকতে পারে না। এটি এমন এক মানবিক আবেদন, যা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য। তবে এই আয়োজনের পবিত্রতা রক্ষা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই, নেতাকর্মীরা যেন মসজিদের পবিত্র পরিবেশ নষ্ট না করে কেবল আন্তরিক প্রার্থনায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। কোনো ধরনের অতি উৎসাহী কর্মকাণ্ড যেন এই মহৎ উদ্দেশ্যকে ম্লান না করে।
এক ইতিহাস রচনাকারীর জন্য প্রার্থনা
বেগম খালেদা জিয়া আজ কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি আমাদের ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। তার আপসহীনতা, তার সংগ্রাম, এবং তার দেশপ্রেমের গল্প আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে। আমাদের আশা, তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এবং দীর্ঘজীবী হন। তার মতো একজন ইতিহাস রচনাকারী নেত্রী আমাদের মাঝে সুস্থভাবে বেঁচে থাকুন, এটাই আমাদের আন্তরিক কামনা।
লেখক: কবি সাংবাদিক ও আবৃত্তি শিল্পী।