আমার জীবনপথে বহু মানুষের সঙ্গ পেয়েছি, যারা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে এসেছেন। এদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য—অনেকেই ছিলেন। জাসদের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ইনু ভাইয়ের (হাসানুল হক ইনু) সাথে আমার পরিচয় কেবল আব্বার সূত্রে নয়, পরবর্তী সময়ে পেশাগত কারণেই নিবিড়তা জন্মেছিল, যখন তিনি আমার পেশা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
অথচ এই ব্যক্তিগত পরিচয়কে পুঁজি করে কিছু মানুষ আমাকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’—এই ফালতু অপবাদ দিতে আসে। আমার তো মনে হয়, যারা এমন নালায়েকসুলভ যুক্তি দেখায়, তারা মূলত রাজনীতি আর পেশাগত সম্পর্কের সীমারেখা বোঝে না। তাদের মস্তিষ্কের ভাঁজে ঈর্ষার বিষবাষ্প ছাড়া আর কিছু নেই।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডের খাতিরে বহু মন্ত্রী-এমপির সাথে আমার ভালো পরিচয় হয়েছে। ছবি-টবিও তোলা হয়েছে অনেকের সাথে। এই যোগাযোগের বৃত্তে কেবল আমার এলাকার মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন, যিনি ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। নীলফামারী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী ও আবৃত্তিকার এবং অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর -এর সাথেও আমার বেশ সখ্যতা ছিল। তাঁর সাথেও প্রথম পরিচয় হয়েছিল আব্বার সূত্রে, কিন্তু পরে তা সাহিত্য সংশ্লিষ্ট কাজ ও আমার পেশার প্রয়োজনে বিস্তৃত হয়। তাঁদের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পেশাগত কারণে যোগাযোগ থাকাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু এইটুকু আত্মিক সখ্য বা পেশার প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই আমাকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগীর তকমা দিতে পারে না। আমি বুক চিতিয়ে বলতে পারি, জীবনের কোনো বাঁকেই আমি কোনো রাজনৈতিক দলের একটি ফোন কলের সুবিধাও নেইনি। আমার কলম কখনও কারও কাছে বন্ধক ছিল না। কারও কাছে সুবিধা নেওয়ার প্রয়োজন আমার পড়েনি; বরং মাঝেমধ্যে তাদেরই প্রয়োজন হয়েছে আমার পরামর্শের। অনেক মন্ত্রী এমপিদের চেয়ে অনেক বেশি এবং প্রায় নির্ভুল রাজনৈতিক এষ্টিমেট করতে পারি বলেই তারা ডাকতেন।
আমার এলাকার সেই মন্ত্রী (অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন) তাঁর একান্ত আলোচনার সময় তাঁর সমস্ত অনুচরদের বাইরে রেখে একান্তে আমার সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁর এই বিশ্বাস এবং নির্ভরতা আমার প্রতি অনেকের মনেই ঈর্ষার আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই ঈর্ষা আমার সততা বা নীতির কাছে কখনোই পাত্তা পায়নি।
আসলে মূল কথাটা হলো—আমি কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা ছিলাম না। ছিলাম একজন স্বাধীনচেতা কলম সৈনিক। আমার কলম সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে চলেছে এবং আমি সব সময় ন্যায়ের পক্ষে অবিচল। সত্য প্রকাশের প্রশ্নে আমি কখনোই আপোষ করিনি অথবা ভয় পাই নি। যখনই দেখেছি অন্যায় হচ্ছে, যখনই অনুভব করেছি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কালো ছায়া নেমে আসছে, তখন আমি মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী—কাউকেই ছাড় দিয়ে কথা বলিনি। আমার কাছে ক্ষমতা নয়, মানুষের অধিকার ও ন্যায়ই ছিল মুখ্য।
আমার কলম ছিল আমার স্বাধীনতার পতাকা। সেই পতাকাকে আমি কোনোদিন কোনো দলের হাতে তুলে দিইনি। আমি জানি, আমার এই স্পষ্ট অবস্থান অনেকের চোখে বিরক্তির কারণ। তবে আমি আজও সেই প্রতিজ্ঞায় অটল: অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এখনও আমি কাউকে ছাড় দেব না—এই বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।
-লেখক: কবি, সাংবাদিক, আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পী