আরাফাতের ময়দান। উত্তাপ এখানে শুধু আবহাওয়ার নয়, ইতিহাসেরও। সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি নিমগাছ—যা বিশ্বের কাছে পরিচিত ‘জিয়া গাছ’ নামে। এই গাছগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একজন রাষ্ট্রনায়ক কীভাবে তার মানবিকতা দিয়ে ভূগোল ও কূটনীতির সীমারেখা পেরিয়ে যেতে পারেন। সেই ৮০’র দশকে, যখন তীব্র গরমে হাজিদের কষ্টের লাঘবে এই গাছ রোপণ করা হয়েছিল, তখন তা ছিল বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে এক সবুজ অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার ছিল মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও পরোপকারের।
আমার মনে হয়, এই গাছগুলো কেবল ছায়া দেয় না, তারা যেন সেই আদর্শের প্রতীক, যা শহীদ জিয়া ধারণ করতেন—অর্থাৎ, মানুষের জন্য কাজ করা, দূরদর্শিতা দেখানো এবং জনকল্যাণকে রাজনীতির কেন্দ্রে রাখা। রাজনীতি মানেই যে কেবল ক্ষমতা নয়, এটি যে মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের এক মহৎ মাধ্যম হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই ‘জিয়া গাছ’।
কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে যখন আজ আমরা বর্তমানের দিকে চোখ ফেরাই, তখন এক গভীর ব্যথা অনুভব করি। যে নেতার হাতে রোপণ করা গাছ আজও মরুভূমিতে শীতলতা ছড়ায়, সেই নেতার আদর্শের অনুসারীরা আজ যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। যে দল একদিন দেশপ্রেম, উন্নয়ন ও ঐক্যের স্লোগান দিত, তাদের মধ্যে আজ অনেকেই যেন বিপথগামী। ক্ষমতার মোহ, অন্তঃকোন্দল এবং আদর্শচ্যুতি সেই সবুজ অঙ্গীকারকে ম্লান করে দিচ্ছে।
আমার বলতে ইচ্ছে করে, আরাফাতের ময়দানের গাছগুলো আজও সরল, শান্ত ও দৃঢ়। কিন্তু তাদের অনুসারীদের মধ্যে সেই দৃঢ়তা ও সরলতা কই? অনেকেই আজ দলীয় আদর্শকে ভুলে ব্যক্তিগত স্বার্থে ডুব দিয়েছেন। জনসেবার মূল মন্ত্রকে উপেক্ষা করে তারা বিভেদ ও অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছেন। এই বিষয়টি কেবল দুঃখজনক নয়, এটি সেই মহৎ নেতার প্রতি এক ধরনের ঔদাসীন্য প্রদর্শন।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রতিটি মহান নেতার মৃত্যুর পর তাদের অনুসারীদের মাঝেই আদর্শের লড়াই শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের আদর্শ ছিল দেশের উন্নয়ন ও জাতীয় ঐক্য। তিনি চেয়েছিলেন, দেশের প্রতিটি মানুষ যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। অথচ তার নাম ব্যবহার করা আজকের রাজনীতিতে যখন আদর্শের এই মূল সুরটিই অনুপস্থিত, তখন মনে হয়—নেতার সেই ত্যাগের ফসল যেন আজ সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না।
আসলে, ‘জিয়া গাছ’ শুধু একটি স্মৃতিচিহ্ন নয়, এটি একটি আয়না। এই আয়না দেখায় যে, একটি ভালো কাজ বহু বছর পরও মানুষকে উপকার দিতে পারে। আর এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, তার অনুসারীদের উচিত নিজেদের একবার প্রশ্ন করা—তারা কি আজও সেই আদর্শের পথেই আছেন, নাকি নিজেদের স্বার্থের বালুকণায় বিপথগামী হয়েছেন? আজকের দিনে এই আত্মসমালোচনা অত্যন্ত জরুরি।
-লেখক: কবি, সাংবাদিক, আবৃত্তিকার ও বাচিক শিল্পী