1. backup@wordpress.com : backup :
  2. info2@icrbd24.com : বার্তা বিভাগ : বার্তা বিভাগ
  3. admin@icrbd24.com : admin :
রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:৪৮ পূর্বাহ্ন

জয়পুরহাটের নবান্ন উৎসব -আউলিয়া পারভীন

আউলিয়া পারভীন
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

বাংলাদেশে রয়েছে বারোটি মাস।প্রতি দুই মাস মিলে হয় একটি খতু।প্রতিটি ঋতুর রয়েছে মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য,যা দিয়ে খুব সহজেই আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা যায়।
ষড়ঋতুর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এখন চলছে হেমন্তকাল।এটি হলো চতুর্থতম ঋতু।কৃত্তিকা ও আদ্রা এ দুটি তারার নামেই কার্তিক আর অগ্রহায়ণ নাম করা হয়।
হেমন্ত ঋতুতে দুপুরের রোদের তেজ কমতে শুরু করে।আস্তে আস্তে বেলা ছোট হতে থাকে।চট করেই যেন সন্ধ্যা নেমে যায়।ত্বকে টান টান ভাব অনুভব হয়।উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা বাতাসে হালকা হিমের ছোঁয়া। হালকা কুয়াশায় গাছের পাতা ও ঘাসের ডগায় সাদা মুক্তো দানার মতো জমে থাকে শিশির বিন্দু।
নানা রকম ফুলে আর সৌরভে ভরে উঠে প্রকৃতি।শিউলি ফুলে ভরে থাকে ভোরবেলার আঙিনা।
এছাড়া,চন্দ্র মল্লিকা,দেব,কাঞ্চন, ছাতিম,মিষ্টি গন্ধের কামিনী,গন্ধরাজ সহ নানা রকম ফুলের সমারোহ।
নারিকেল হলো হেমন্তের প্রধান ফল।এছাড়া কামরাঙা, চালতা,কদবেল,আমলকী,ডালিম,
ইত্যাদি ফলের সমারোহ দেখা যায় এ ঋতুতে।
এসময় ঘরে ঘরে নতুন ধান তোলার আনন্দে মেতে উঠে গ্রাম বাংলার মানুষ।এ ঋতুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নবান্ন উৎসব।
এক সময় বাংলার বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস হিসাব ধরে। নববর্ষ পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে অগ্রহায়ণ। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির। এ মাসেই নতুন ধানের চালে পালিত হতো নবান্ন।
ডঃ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে,বাঙালির নববর্ষের উৎসব ছিল নবান্ন।
নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন।আর এ উৎসব হলো আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুতকৃত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসব।
বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব হলো, এই শষ্যভিত্তিক লোকজ উৎসব নবান্ন।যুগ যুগ ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে অগ্রহায়ণ মাসের এক তারিখ।
এ দেশের সকল ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর নিকট এ উৎসব একটি সার্বজনীন উৎসব।তবে নবান্ন উৎসব নানা ভাবে পালিত হতে দেখা গেছে। যপমন, উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে বৈশাখে রবি শস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে নবান্ন পালন হয়।
সাঁওতাল, উসুই,গারো,জুম চাষি ম্রো উপজাতি পৌষ ও মাঘ মাসের শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদ্‌যাপন করে এ উৎসব।
আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে হেমন্তের আমন ধান কাটার পর রয়েছে এ উৎসবের নানা আয়োজন।
তাদের উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল নতুন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা।পরে দেবতা,অগ্নি,কাক,ব্রাহ্মণ ও আত্মীয় স্বজনদের নিবেদন করে গৃহকর্তা ও তার পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করতেন।এ উপলক্ষ্যে বাড়ির উঠোনে,ঘরের মেঝেতে আলপনা আঁকা হতো।জয়পুরহাট জেলাধীন সকল উপজেলায় যে-সব মাটির তৈরি বাড়ি আছে সেগুলোর দেয়ালে সুন্দর সুন্দর আলপনায় রঙিন করে তুলতো গৃহ কন্যা ও বধূগণ।প্রতিটি গ্রামের মেঠো পথ আর গৃহের পরিবেশ হয়ে উঠত সৌন্দর্যপূর্ণ ও আনন্দঘন মধুময়।
সবখানেই গুড়ি কোটার শব্দ ও শাঁখের শব্দে,মুখরিত হয়ে উঠে।
তেমনি মুখরিত হয়ে উঠে জয়পুরহাট সদর হতে ২২ কিলোমিটার পূর্বে কালাই উপজেলার বেগুনগ্রাম নামক জায়গাটি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এ গ্রাম বেশ সমৃদ্ধ। এখানকার সুজলা সুফলা সবুজ প্রকৃতি আর মনোরম পরিবেশ মুগ্ধ করার মতো।
গ্রামের প্রত্যেকটা বাড়িতে নবান্নের আনন্দ আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা ।
এখানে মোঃ আব্দুল বারী চৌধুরী পেশায় শিক্ষকতা করেন অবসর গ্রহণ করার পর তার ছেলে মো. হেফজুল বারী চৌধুরী পেশায় একজন ডাক্তার হয়েও শত ব্যস্ততায় ধরে রেখেছেন এ উৎসব।
উল্লেখ্য যে, এই চৌধুরী পাড়ায় আস্তানায়ে চিশতিয়া হজরত খাজা শাহ মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল গফুর চিশতী রাঃ এর খানকায়ে চিশতীয়ার দরবার শরীফ অবস্থিত।ভারতের হজরত খাজা মাওলানা মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন চিশতী রা. এর কাছে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণের পর তারই নির্দেশে বাংলা ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে আস্তানা তৈরি করে। এখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি তিনটি বৃহৎ মাদ্রাসা,বহু মসজিদ,নির্মাণ করেন।এখানে রয়েছে সুন্দর একটি সান বাধানো সুবিশাল দীঘি।
প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার এখানে এই নবান্নের আয়োজন করা হয়।রীতি অনুযায়ী এই আস্তানায় প্রবেশ করলে না খেয়ে কেউ ফিরে না।
এই বছর বৃহস্পতিবার ১৬ ই নভেম্বর ২০২৩ তারিখের উক্ত স্থানের নবান্ন অনুষ্ঠানিত হয়।বাংলাদেশের বৃহত্তম হলো এই নবান্ন উৎসব।উৎসব ছিল দিন জুড়ে মেলা।নতুন ধানের ৯০ মন চাল ১৩০ মন গুড়,৩ হাজার নারিকেল ও ৮০ মনের দুধের সমন্বয়ে ৩০ টি চুলায় রান্না করা ক্ষীর দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় গ্রামবাসীকে।এছাড়া এই জেলা ধান,ফল আর ,আলুর জন্য বিখ্যাত।তাই নতুন চালের ক্ষীর,ভাত পাশাপাশি খাসীর মাংস দিয়ে আলু ঘাটি এক বিশেষ ও সুস্বাদু খাবারও এখানে আয়োজন করা হয়।আয়োজক কমিটির সদস্য মোহাম্মদ হেফজুল বারী চৌধুরীর ভাষ্যমতে, এখানে নববর্ষ পালন সেভাবে পালন না হলেও নবান্ন উৎসব খুবই জোড়ালো ও গুরুত্বের সাথে পালন করা হয়।এখানে হজরত শাহ সুফি আব্দুল গফুর চিশতী ১৩৩১ বঙ্গাব্দ হতে এ নবান্ন উৎসব শুরু করেন।সেই থেকেই প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার সকাল হতে রাত ১২ পর্যন্ত এই উৎসব পালন করা হয়।উৎসব নিরাপত্তায় প্রতি বছরেই থাকে,আনসার, গ্রাম্য পুলিশ ও পুলিশ বাহিনীর টিম।
দূর হতে এখানে কেউ এলে থাকা খাওয়া ফ্রি এবংআপ্যায়ন যেন আত্মীয়তার বন্ধনের কথা বলে।
এছাড়া প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি আলাদাভাবে প্রিয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ আর উপহারের সমারোহ। এখানে এই দিন উপলক্ষ্যে বিশেষ এক মেলার আয়োজন করা হয়।পাওয়া যায় না এমন জিনিস দুরূহ।
বাংলাদেশের যে কয়েকটি উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তাদের মধ্যে বাঁশ,বেত আর মাটির জিনিস পত্র অন্যতম।এগুলোকে লোকজ শিল্ল বলা হয়।কাঠের তৈরি সরন্জামও কম নয়।যাইহোক,সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ও বেশির ভাগ তারাই এসব ব্যবহার করে।তবে বর্তমান এর চাহিদা নাগরিক জীবনেও শৌখিনতা আর সজ্জাতে কম নয়।ইহা ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীদের জীবনাচরণ ও অনুভূতির প্রতীক।।

নবান্নের এই মেলাতে লোকজ শিল্পের দেখা মেলে।যেমন,হাত পাখা(,তাল পাখা, সুতার পাখা,কাপড়ের পাকা,) নানান সুরের বাঁশের বাঁশি,,ঢোল,গোলা,গুড়া,বাউনি,ঝুড়ি,ডুলা,মোড়া,কুলা,চালুন,খাঁচা মই,চাটাই,মাছ ধরার চাই, নানা রকমের মাছ ধরার বড়শি,

মাথাল,সোফাসেট,বই পত্র ও রান্না ঘরের জিনিস পত্র রাখার আলমারি,ঘরের বেড়া,বেলকি,দরমা,মাটির পুতুল,প্লেট,গ্লাস,কাপ পিরিচ, ল্যাম্পদানী,নানা রকমের ছোট বড় আকারের সুন্দর সুন্দর শেপিছ,পশু পাখী ইত্যাদি।
এছাড়া আছে নানান রকম রঙিন ঘুড়ি।এ উৎসবে আকাশে ঘুড়ি উড়াতে বেশ মজার শৈশব।

জয়পুরহাটে আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এ জেলার মানুষ বেশ আতিথেয়তাপরায়ন।মিষ্টান্ন থেকে শুরু করে পিঠার সমাদরও কম নয়।
এই নবান্নের মেলায় চার কেজি ওজনের ইলিশ মাছের আকৃতিতে বানানো মিষ্টি খুবই সুস্বাদু।কাঁচা গোল্লা,কালো জাম, হাড়িভাঙা মিষ্টি,আকবরিয়ার দই,সরার দই,হাড়ির। দি,শাহী দই,ক্ষিরশা দই,,ছানার জিলাপি,চমচম,ছানার গজা,ছানার ক্ষীর,ছানার পায়েস,নারিকেলের ও ,তিলের, নারু,পাটিসাপটা,,রাস কদম,কদম ভোগ,জামাইভোগ,নানা রকম সন্দেশ,মালাই টোস্ট,বরফি,রসমালাই,ডায়াবেটিস মিষ্টি, চিনির তৈরি নানা রকম পশু পাখির আকৃতিতে বানানো বাতাসা ইত্যাদি।পিঠাও তো কম নয়।ডিম,মিষ্টি,ও ঝাল দিয়ে নানা রকম নকশী পিঠার জন্য এ নবান্ন বিখ্যাত।
বিনোদনের কথা তো বলাই বাহুল্য।নাগরদোলা, নৌকাদোল, ইলেকট্রিক ট্রেন,কুমির,চরকি,শিশুদের বেশ আনন্দের।আর পড়ন্ত বিকেলের পর হতে শুরু হয় বায়স্কোপ, পুতুল নাচ,সন্ধ্যার পর বসে পালা গান,কবি গান,বাউল গান,মারফতি,মুর্শিদী গানের আসর।বিভিন্ন জেলা উপজেলা হতে আগত এই বাউল শিল্পীর দল মুখোরিত ও আনন্দপূর্ণ করে তোলে এ মেলার আলোক সজ্জাময় রাত্রী বেলা।
এখানেই এ উৎসবের শেষ নয়।গ্রাম বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারণ করে এখানকার মাছের মেলা।মাছের মেলার নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে বড় বড় সব নানা রকমের মাছের স্বপ্নিল রূপ।আর এ স্বপ্নের বাস্তব রূপ পেয়েছে কালাই উপজেলার পাঁচশিরা বাজারে। থরে থরে সাজানো আছে মাছ। ১ কেজি হতে ৩০ কেজি ওজনের মাছ পাওয়া যায় এই মেলায়।
সাধারণত নবান্নের নিমন্ত্রণে জামাই এ বাজার হতে তার সাধ্য মতো সবচেয়ে বড় মাছটি কিনে হাতে ঝুলিয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়।
প্রাণের নবান্ন উৎসব।আহা!হেমন্ত কাল।সোনা রং ছড়া পাকা ধানে অবারিত ফসলের গানে,বাংলার বিস্তৃত নদীর কলতানে,সৃষ্টির আর আত্মীয়তার বন্ধনের উল্লাসে,মায়ের স্নেহ ভরা ডাকে,প্রাণের আনচান, ভরে উঠে চোখের কোণ,ভিজে যায় দুই গাল,খুনসুটিতে ভরে উঠে প্রিয় মুখ বোন আর বধূর আলাপনে।সেই হালখাতা,থাকবে না এবার আর কোনো ঋণ বাকী,সেই গ্রাম্য লোকজ মেলা,বুড়ো বট গাছ।
শিশুর বাঁশিতে মুখরিত মেলার প্রাঙ্গণ আর রঙিন ঘুড়িতে ভরপুর শৈশবের হেমন্তের আকাশ।
এক কথায়, নবান্ন উৎসব মানেই বাঙালির আত্মীয়দের এক মহামিলন মেলার উৎসব।
একটি পরিপূর্ণ মুখরিত ভোজ।
এ গ্রামের বাঁশবন, খেঁজুরবন, পিচঢালা রাস্তার দু ধারে সারি সারি ইউক্লেপটাস, আকাশমনি গাছ, আর আমের বাগান আলোকিত ছিল,হেমন্তের এই মায়া ভরা জ্যোৎস্না রাতে।

Please Share This Post in Your Social Media

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর
All rights reserved © 2013- 2024